Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ঠ্য

ঠাকুরগাঁও জেলার জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বাংলাদেশের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হলেও এই জনপদের জনধারার বৈচিত্রের কারণে এখানে পরিদৃষ্ট হয় বহুমাত্রিক নৃ-বৈশিষ্ট্য। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি প্রধান ভাষাগোষ্ঠী ইন্দো ইউরোপীয়, দ্রাবিড় ও মুন্ডা ভাষার বিপুল সংখ্যক অধিবাসী এই জেলায় বসবাস করে। এছাড়া ‘বোডো’ ভাষা গোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনসাধারণও এ জেলায় বসতি স্থাপন করেছে। ঠাকুরগাঁও জেলার জনধারার মধ্যে রয়েছে হিন্দু ও মুসলিম প্রধান জনধারা, সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, কোচ, পলিয়া, রাজবংশী, হো, মাহতো, মালো, কুকামার, হাড়ি, ভূঁইয়া, গাংখু প্রভৃতি। এই জনধারার মিশ্র রূপায়নেই গড়ে উঠেছে ঠাকুরগাঁও জেলার নৃতাত্ত্বিক ভিত্তি।

বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী মোটামুটি দীর্ঘমুন্ড, প্রশস্ত নাসা, আদি অস্ট্রেলীয় বা কোলিড; দীর্ঘমুন্ড, দীর্ঘ ও মধ্যোন্নতনাসা, মিশর-এশীয় বা মেলানিড এবং বিশেষভাবে গোলমুন্ড, উন্নত নাসা, অ্যালপাইন বা পূর্ব ব্র্যাকিড, এই তিন জনধারার সমন্বয়ে গঠিত।

নৃতত্ত্ববিদগণ প্রায় সকলেই এই অভিন্ন মত পোষণ করেন যে, নিম্নবর্ণের বাঙ্গালী এবং আদিবাসী উপজাতিদের মধ্যে আদি-অস্ট্রেলীয় জনধারার প্রভাব রয়েছে সবচেয়ে অধিক। বত্তুত, আর্য এবং জনধারা পশ্চিম দিক থেকে আগমন করলেও আদি অক্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠী অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আগমন করে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে মধ্য ও উত্তর ভারতে; এমনকি, এদের নতুন বসতভূমি বিস্তৃত হয় দক্ষিণভারত ও সিংহল পর্যন্ত। সিংহলের ‘ভেদ্দাপ্রতীম’ আদিবাসীরা পূর্বসূরী বাঙালীদের সমজাতীয় বলে অনেকের ধারণা। নৃতত্ত্ববিদ ফন আইকস্টেড বাংলাদেশের আদি অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীর নামকরণ করেছেন ‘কোলিড’। ঠাকুরগাঁ জেলার জনধারার একটি বৃহৎ অংশ আদি-অস্ট্রেলীয় জনধারার অন্তর্গত। এদের নৃ-বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দীর্ঘ শিরাকার, প্রশস্ত নাক, নাকের গোড়া অক্ষিকোটর থেকে খুব উঁচু নয়, কপাল কিছুটা ভেতরের দিকে চাপা ও ভ্রুর হাড় কিছুটা উঁচু। মুখের নিম্নভাগ কিঞ্চিৎ লম্বা ধরণের। ঠোঁট যথেষ্ট মোটা। থুতনি কিছুটা কম উঁচু। মাথার চুল তরঙ্গায়িত ও কুন্ডলাকৃত। চুলের রং গাঢ় বাদামী থেকে কাল। দাড়ি গোঁফ মোটামুটিভাবে হয় কিন্তু দেহে লোমের পরিমাণ কম। গাত্রবর্ণ বাদামী থেকে ঘোরতর কালো। দেহাকৃতি খাট ও খর্বকায় (৫ ফুট ২ ইঞ্চি)। ঠাকুরগাঁ জেলার আদিম অধিবাসী, সাঁওতাল ওঁরাও এবং মুন্ডা জনগোষ্ঠী এই মানবধারার অন্তর্গত। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ঠাকুরগাঁয়ের আদিবাসী উপজাতি এবং নিম্নবর্ণের হিন্দু মুসলমানের রক্তে এই জনধারার প্রভাব সবচেয়ে বেশী। কিন্তু এছাড়াও এই জনপদের কিছু কিছু উচ্চ বংশীয় জনসাধারণের মধ্যেও এই মানবগোষ্ঠীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

পামীর মালভূমি, তাকলামাকান মরুভূমি, আল্পস পর্বত (তুর্কী বা তুরানীর) দক্ষিণ আরব ও ইউরোপের পূর্বাঞ্চল বাসী গোলমুন্ড বিশিষ্ট একটি প্রবাহ বাংলাদেশের জনধারায় নিজেদের রক্তপ্রবাহ সঞ্চারিত করে। এই জনের সর্বপ্রাচীন সাক্ষ্য সংগৃহীত হয়েছে হরপ্পা ও ‘মোহেন জো-দারোতে’ প্রাপ্ত কংকাল থেকে। এই জনধারাকে নৃতত্ত্ববিদ লাপোং রিজলী লুসমান ও রমাপ্রসাদ চন্দ্র অ্যালপাইন নরগোষ্ঠী রূপে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলাদেশের উচ্চবর্ণের ও উত্তম মিশ্র বর্ণের জনসাধারণের মধ্যে যাদের গোল ও মধ্যম মুন্ডাকৃতি তীক্ষ্ণ, উন্নত ও মধ্যম নাসাকৃতি এবং মধ্যম দেহ-দৈর্ঘ্যের লক্ষণ দেখা যায়, তা অনেকাংশে ‘অ্যালপাইন’, নরগোষ্ঠীরই দান। এই জনগোষ্ঠীর রক্তধারা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ঠাকুরগাঁ জেলার ব্রাম্মন, কায়স্থ, বৈদ্যসহ উপরের বর্ণস্তরের লোকদের এবং উচ্চ শ্রেণীর মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও বিদ্যমান। বস্ত্তত বাংলাদেশে যে নৃবৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে তার প্রায় সমগ্র মূল রূপায়নই প্রধানত ‘অ্যালপাইন’ ও ‘আদি-অস্ট্রেলীয়’ এই দুই জনধারার লোকদেরই র্কীতি।

‘বোডো’ ভাষাগোষ্ঠী বা মোঙ্গলীয় নরগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোচ রাজবংশী, পলিয়া ইত্যাদি জাতির একটি প্রধান ধারা ঠাকুরগাঁ জেলায় পরিলক্ষিত হয়। এদের নৃবৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ: নাক মধ্যমাকৃতি থেকে চ্যাপ্টা; মাথার আকৃতি সাধারণত গোল; অক্ষিপট সম্মুখীন; উন্নত গন্ডাস্থি, কেশবিহীন দেহ ও মুখমন্ডল; চুল সোজা; দাড়িগোফ বিরল, গায়ের রং পিতাভ অথবা পিতাভ বাদামী। এই জনগোষ্ঠী অতি প্রাচীনকালে দক্ষিণ পশ্চিম চীন হতে ক্রমশ: ব্রহ্মদেশ, মালয় উপদ্বীপ এবং পূর্ব দক্ষিণ সমুদ্র উপকূলীয় দেশ ও দ্বীপগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছিলো। পথে উত্তর আসামে এবং উত্তর ব্রক্ষ্মপুত্র উপত্যকায় মিরি, নাগা, ‘বোডো’ বা মেচ সম্প্রদায়ভূক্ত কোচ, পলিয়া, রাজবংশী প্রভৃতি লোকের মধ্যে একটি ধারা প্রবাহ ঐতিহাসিক কালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে এসে ঢুকে পড়ে এবং রংপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি প্রভৃতি অঞ্চলে এভাবেই খানিকটা মোঙ্গলীয় প্রভাব সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের রক্তে আত্মপ্রকাশ করেছে। ঠাকুরগাঁ জেলার কোচ, পলিয়া, রাজবংশী উল্লিখিত জনধারারই উত্তরসূরী।

দীর্ঘ শিরাকার ও প্রশস্ত নাসা বৈশিষ্ট্যসহ আদি অস্ট্রেলীয় এবং মোঙ্গলীয় রক্তের মিশ্রণজাত আরো কয়েকটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী এ জেলায় পরিদৃষ্ট হয় যেমন: মালো, মাহতো, ভূঁইয়া, হাঁড়ি, হো, কুকামার, গাংঘু প্রভৃতি।

ঠাকুরগাঁ জেলার প্রাচীনতম জনগোষ্ঠী কারা, এ ব্যাপারে কোন তথ্যই আমাদের হাতে নেই। তবে স্থানীয় অধিবাসীদের শারীরিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের নিরীখে এ ধারণা সহজেই গ্রহণ করা চলে যে, তাদের পূর্ব পুরুষগণের অনেকেই ছিলেন আদি অস্ট্রেলীয় নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। বস্ত্তত, সাঁওতাল, ওঁরাও প্রভৃতি আদিবাসী প্রতীম জনগোষ্ঠী সরাসরি আদি-অস্ট্রেলীয় নৃজাতিভূক্ত হলেও ঠাকুরগাঁ জেলায় তাদের আগমন ঘটেছে অতি সাম্প্রতিক কালে। স্যার জি.এ গ্রীয়ার্সন ১৯০৬ সালে মালদা জেলার সাঁওতালদের সম্পর্কে বলেছিলেন যে, তারা এই জেলার পূর্বাঞ্চলে (অর্থাৎ দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁ অঞ্চলে) এসেছে বড় জোর ২০ বছর পূর্বে। মানববিজ্ঞানী পিয়েরে বেসাইনেত সাঁওতালদের আগমনের কারণ নির্দেশ করে বলেছেন যে, তারা বাংলাদেশের বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় এসেছিলো জমি পরিস্কার করে চাষাবাদের জন্য, মজুর হয়ে রেল লাইন বসাতে এবং অন্যান্য মজুর খাটার উদ্দেশ্যে। সুতরাং ভারতের দক্ষিণ বিহার, বীরভূম ও ছোটনাগপুর থেকে সাঁওতাল ও ওঁরাও জনগোষ্ঠীর ঠাকুরগাঁয়ে আগমন ও বসতিস্থাপনের সময়কাল ১৫০ বছরের বেশী কোন মতেই হতে পারে না। বস্ত্তত এই জনপদের বিপুল সংখ্যক জনসাধারণের আদি অস্ট্রেলীয় নৃজাতিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত আদিবাসী সূত্রে প্রাপ্ত নয়; বরং এই সংমিশ্রণ ঘটেছে হাঁড়ি, চন্ডাল শবর, শুদ্র প্রভৃতি নিম্ন বর্ণের মানুষদের কাছ থেকে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাগীতির শবর, ডোম ইত্যাদি নিম্নবর্ণের মানুষদের সমজাতীয়। এ অনুমানকে দৃঢ়িভূত করে এই জেলায় বসতি স্থাপনকারী প্রাচীন অন্যতম বিখ্যাত কবি গোরক্ষনাথের অস্তিত্বের বিষয়টি। শুধু গোরক্ষনাথই এ জেলায় জীবন যাপন করেছিলেন অন্য আর কোন চর্যাকার ছিলেন না, এ কথা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেন না। অর্থাৎ বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন থেকে এই জেলার প্রাচীন নৃগোষ্ঠীর সূত্র খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়।

অ্যালপাইন জনগোষ্ঠী এই জেলায় আগমন করেছে মূলত অষ্টম-নবম শতক থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে। সাধারণত বহিরাগত জনগোষ্ঠীই এই জনধারার অন্তর্গত। গুপ্ত, পাল ও সেন রাজত্বকালে যেমন বহিরাগত হিন্দু মানবধারা এই জনপদে বসতি স্থাপন করেছে; তেমনি সুলতানী, তুর্কী ও মোগল শাসনামলে উত্তরভারতীয় মুসলিম জনধারাও এ অঞ্চলে আগমন করেছে।

বর্তমান ভারতের মালদা জেলায় অবস্থিত গৌড়, গুপ্তপাল ও সেন রাজত্বকালে ছিলো ঠাকুরগাঁ জেলার কাছাকাছি রাজধানী নগরী। একইভাবে বিশেষত সুলতানী আমলেও ‘গৌড়’ এ জেলার উপর সুগভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। ঠাকুরগাঁ জেলার অন্তর্গত ভাতুরিয়া, রাণীশংকৈল প্রভৃতি অঞ্চল ‘গৌড়’ ও ‘তান্ডা’ রাজদরবার কর্তৃক শাসিত হয়েছে সরাসরি। রাজা গণেশ ছিলেন এ অঞ্চলেরই জমিদার ও পরে গৌড়েশ্বর ঠাকুরগাঁ জেলায় হিন্দু প্রাধান্যের পেছনে শত শত বছর যাবত নিকটবর্তী ‘গৌড়’ রাজধানী এবং তার শাসকদের আনুকূল্যে প্রবর্তিত হিন্দু ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাস অনেকাংশে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।

সুলতানী আমলে গৌড় রাজ্যে উত্তরভারত ইরান, আরব ও আফ্রিকার হাবশী সৈন্য, কর্মচারী অজস্র সংখ্যায় আগমন করেছিলো। তাদের অনেকেই স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছে রাজধানী গৌড়ের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে। ঠাকুরগাঁ জেলা একই সঙ্গে ‘গৌড়’ রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত এবং রাজধানীর নিকটবর্তী। সুতরাং মুসলিম সৈন্য ও কর্মচারীরা এই জেলায় স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তুলেছিলেন সেটাই স্বাভাবিক। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়, এ জেলার বৃহত্তর সুমলিম জনগণ নিম্নশ্রেণীর জনসাধারণ থেকে ধর্মান্তরিত, কিছু সংখ্যক মুসলিম বহিরাগত। এই বহিরাগত মুসলিমদের অধিকাংশই অ্যালপাইন নরগোষ্ঠীভূক্ত।

মোগল আমলে সম্রাট আকবর সুবেবাংলাকে যে ১৯টি সরকারে বিভক্ত করেছিলেন তার মধ্যে ‘সরকার তাজপুর’ ও ‘সরকার পাঞ্জারা’ ঠাকুরগাঁ জেলার সীমানভুক্ত। এছাড়া মোগল সামরিক অবস্থান ‘সরকার ঘোড়াঘাট’ ঠাকুরগাঁ অঞ্চলকেও নিয়ন্ত্রন করতো। সর্বোপরি দিল্লি থেকে গৌড় অথবা পূর্ব বঙ্গে যাতায়াতের পথে এ জেলার পার্শ্ববর্তী অবস্থান বহিরাগত প্রভাবও স্থায়ী বসবাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। এভাবেই ঠাকুরগাঁ জেলায় হিন্দু প্রাধান্যের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুসলিম প্রভাব।

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর ভারত থেকে এবং ১৯৫০-৬০ দশকের দিকে পূর্ব বঙ্গের নোয়াখালী, ঢাকা, পাবনা এবং বিশেষভাবে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা থেকে কয়েক লক্ষ লোক এসে ঠাকুরগাঁ জেলায় আবাসন গড়ে তুলেছে। ভারতীয়দের মধ্যে কিছু সংখ্যক উর্দুভাষী এবং প্রায় উর্দুভাষী জনসাধারণও ছিলেন যারা মূলত আদি অস্ট্রেলীয় ও অ্যালপাইন নরগোষ্ঠীর অন্তর্গত। পূর্ববঙ্গীয় অধিবাসীদের অধিকাংশই আদি-অস্ট্রেলীয় মানবধারার অন্তর্ভূক্ত। বলাবাহুল্য, ভারতীয়দের সঙ্গে স্থানীয় জনদের সংমিশ্রণ খুব একটা ঘটেনি। একইভাবে, পূর্ববঙ্গীয় জনদের সঙ্গেও স্থানীয় সংমিশ্রন অত্যন্ত বিরল। অতি সম্প্রতি কোন কোন ক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে।

ঠাকুরগাঁ জেলার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে-মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এবং বোডো ভাষা ব্যবহারকারী কোচ, পলিয়া ও রাজবংশী জনদের ব্যাপক সংখ্যায় বসতি স্থাপন।

নৃতাত্ত্বিক বিচারে রাজবংশী কোন স্বতন্ত্র জাতি কিংবা কোচ ও মেচ জাতির সংমিশ্রনে উদ্ভূত কিনা এ ব্যাপারে মতদ্বৈততা রয়েছে। ইংরেজ ঐতিহাসিক এবং মানব বিজ্ঞানীগণের মধ্যে যেমন: ড: উইলিয়াম হান্টার, এইচ বিভারলে, এইচ এইচ রিজলী, এ.ই পোর্টার প্রভৃতির অভিমত হচ্ছে কোচ, রাজবংশী এবং পলিয়া মিশ্র জাতি কিনা এব্যাপারে সনেদহ থেকে যায়। নৃবিজ্ঞানী রমাপ্রসাদ চন্দের মতে তিববতীয় বা মঙ্গোলীয় আকারের কোচ, পলিয়া ও রাজবংশী প্রভৃতি জাতি তিববতীয় বা ভুটিয়া আক্রমণকারীগণের অনুচরদের বংশধর বলেই মনে হয়। নৃতাত্ত্বিক ভাষাতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বিচারে কোচ ও রাজবংশীকে দুই ভিন্ন জাতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন রংপুর ধর্মসভার সভাপতি যাদবেশ্বর তর্করত্ন। তিনি জানান, কোচ ও রাজবংশী দুইটি পৃথক জাতি। সকল কোচেরই মঙ্গোলীয় গড়ন। আদিম কোচ কৃষ্ণবর্ণ। পুজা বিষয়ে কোচ ও রাজবংশী জাতির মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ডক্টর হ্যামিল্টন ও স্যার রিজলী প্রমূখ নৃতত্ত্ববিদগণ উল্লেখ করেন যে, কোচ, পলিয়া ও রাজবংশী মূলত: একই গোষ্ঠীভূক্ত তিনটি শাখামাত্র।

রাজবংশীরা বর্তমানে নিজেদের কোচ জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে পরিচয় দিতে অস্বীকার করে। আসলে এদের মধ্যে পার্থক্যও রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। কোচ ও রাজবংশীরা উভয়ে মাতৃতান্ত্রিক সমাজভূক্ত হলেও ধর্মীয় অনুরক্তিতে কোচরা শৈব প্রভাবিত; পক্ষান্তরে রাজবংশীরা বৈষ্ণব ভাবাপন্ন। কোচ রমনীরা এক কালে শিবপূজায় পৌরহিত্য করতো বলে শিবকে কোচ নারীদের প্রতি আসক্ত বলে বিশ্বাস করা হতো। ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ কথাটিও সম্ভবত কোচ নারীদের কাছ থেকেই প্রসার লাভ করেছে।

কোচ ও রাজবংশীদের উৎপত্তির ইতিহাসটিও এ প্রসঙ্গে জেনে নেয়া যায় । প্রাচীন কামরূপ রাজ্য অহোম ও কোচ জাতি দ্বারা অধিকৃত হয়। অহোমরা পূর্ব কামরূপ এবং কোচরা পশ্চিম কামরূপ (বর্তমান কোচবিহার, রংপুর ও পঞ্চগড়ের কিয়দংশ) দখল করে নেয়। পরিশেষে কোচরা কেন্দ্রীভূত হয় কোচবিহার ও বৈকুন্ঠপুরে। কোচদের প্রধান ও প্রথম নায়কের নাম ‘হাজো’। তিনি খেন জাতিদের হারিয়ে ১৪৯৬ খ্রীষ্টাব্দে কোচ রাজবংশের সৃষ্টি করেন এবং ৪৪০ বৎসর পর্যন্ত রাজত্ব করেন তার উত্তরসূরীগণ। ‘হাজো’ ছিলেন ‘বোডো’ জাতির মানুষ। ‘বোডো’ জাতি পাটকই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের কূল ধরে উত্তরপূর্ব আসামে এসে পৌঁছেছিলেন। আসামের পশ্চিমভাগ ও নেপালের তরাইভূমির পূর্বভাগ হাজোর অধীনে ছিলো।

কোচনায়ক হাজোর দৌহিত্র শিশু ও বিশু শিশ্বসিংহ ও বিশ্বসিংহ নাম ধারণ করে যথাক্রমে-বৈকুষ্ঠপুর (জলপাইগুড়ি) ও কোচবিহারের রাজা হন। এই ভাবে দুই ভাই উপজাতির পর্যায় থেকে রাজার পর্যায়ে উন্নীত হন এবং হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে নিজেদের প্রচার করতে থাকেন ‘রাজবংশী’ নামে। এইভাবে তাদের ‘কোচ’ নাম ঘুচে গেলো। রাজবংশীরা এখন নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে দাবী করে থাকেন। কিন্তু নৃবিজ্ঞানী এইচ.এইচ. রিজলী বলেন যে, তাদের এই দাবীর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। এইচ বিভারলি ১৮৭২ সালের ‘Census Report of Bengal’  এর প্রথম খন্ডে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, কোচ রাজবংশী এবং পলিয়া একই জাতি ড. জি.এ গ্রীয়ার্সন মনে করেন কোচ, মেচ, বোডো একই জাতির বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন, বড়জোর একই জাতির মধ্যে কিছুটা স্বতন্ত্রধর্মী। কোচরা আসলে হিন্দু বৈশিষ্ট্যজাত বোডো সম্প্রদায়। তারা প্রাচীন ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য হিন্দু ধর্মে বিসর্জন দিয়েছে এবং প্রাচীন বোডো ভাষা আত্মীকৃত করেছে আসামী ও বাংলা ভাষার মধ্যে ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ মানুষ বোডো অর্থাৎ মিশ্র অস্ট্রিক-দ্রাবিড়-মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীভুক্ত। তারা প্রধানত এখন ‘কোচ’ নামেই পরিচিত এবং বর্তমানে হিন্দু বা প্রায় হিন্দু ধর্মের অর্ন্তভূক্ত। সেই সঙ্গে এরা মূল তিবেতো বার্মিজ ভাষা হারিয়ে এখন ব্যবহার করছে উত্তরবঙ্গীয় উপভাষা। 

ঠাকুরগাঁ জেলায় বর্তমানে মোটামুটি ৫০ হাজার কোচ, ১ লক্ষাধিক রাজবংশী এবং ৬০/৭০ হাজার পলিয়া জনগোষ্ঠী বসবাস করে থাকে। এ জেলার লৌকিক ধর্ম বিশ্বাস, প্রথা, উৎসব এবং সাংস্কৃতিক পরিচর্চায় এই তিন জনগোষ্ঠীর অবদান সর্বাধিক। অনুমান করা হয় যে, এদের মধ্য থেকেই ইসলাম ধর্মান্তরকরণ প্রক্রিয়া সবচেয়ে বেশী সম্পন্ন হয়েছে।

নৃবিজ্ঞানী রিজলীর পরিমাপে বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর গড় নৃ-বৈশিষ্ট্য জ্ঞাপক সূচকাঙ্ক হলো শিরাঙ্ক ৭৮.০ সে:মি:, নাসাংক ৭৭.৫ সে:মি এবং উচ্চতা ১৬৩.৪ সে:মি। পক্ষান্তরে গবেষক গৌতম শংকর রায় দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি এলাকার রাজবংশীদের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করেছেন এভাবে-শিরাঙ্ক ৭৫.৮ সে:মি: নাসাংক ৭২.৪ সে:মি: এবং উচ্চতা ১৬০.৩ সে:মি:। 

বস্ত্তত, পার্শ্ববর্তী এলাকা হিসেবে ঠাকুরগাঁ জেলার রাজবংশীদের নৃ-বৈশিষ্ট্যও প্রায় অনুরূপ। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মতো এ জেলার মুসলিম জনগোষ্ঠীর নৃবৈশিষ্ট্য জ্ঞাপক সুচকাঙ্কও কম বেশী একই রকম। সুতরাং আদিবাসী, উপজাতি অধ্যুষিত এবং বহিরাগত জনধারার সংমিশ্রনে গড়ে উঠা ঠাকুরগাঁ জেলার নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়কে এভাবে সূত্রবদ্ধ করা চলে যে, এ জেলার মানবধারা মূলতঃ ‘মিশ্র অস্ট্রিক-মঙ্গোলীয় অ্যালপাইন’ নরগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে।